শহরের চুপকথা

শুভদীপ


“ওখানে বসে বসে ঝিমানোর জন্যে তোকে মাইনে দিই নাকি রে শালা, শুয়োরের বাচ্চা…?"

ঠিকাদারের খন্‌খনে আওয়াজে সম্বিত ফিরল পলাশের। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে এই জায়গাটাতে এসে পড়তেই একগাদা পুরনো ছবি মাথার মধ্যে খলবল করে উঠেছিল। দু'টো মাঠের মাঝখানে জল বয়ে যাওয়ার জন্য একটা আপাত-চওড়া নালা। একটু দূরের বড় পুকুরটা থেকে জল নেওয়ার জন্য পাশের কারখানা থেকে বোধহয় কাটা হয়েছিল নালাটা। দু'পাশের উঁচু জমিতে একটা কাঠের পাটাতন দিয়ে জলে পা ডুবিয়ে তার উপর বসে থাকত সে আর আমিনা। পাখির ডাক শুনে আর কারখানার চিমনিটা থেকে গলগল করে বেরনো ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে বলতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত তাদের। কারখানাটা তো ওদের এখান থেকে উচ্ছেদ হওয়ার মাস ছয়েক আগে থেকেই বন্ধ। ওর অনিলকাকুও কাজ করত ওখানেই বস্তির বাকিদের মতোই। কি সমস্ত দাবী নিয়ে কিছুদিন ধরেই একটা ধর্মঘট চলছিল। রোজ চার-পাঁচটা লোক এসে বস্তির সবাইকে এক জায়গায় বসিয়ে কি সব যেন বোঝাত।

সেদিন সকালে আমিনাই ওকে বললো ওই যে চার-পাঁচটা লোক রোজ আসতো, তাদের মধ্যে একজনকে নাকি পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে আর বাকিরা বেপাত্তা। সেদিন সারাদিনই অনিলকাকু অস্থিরভাবে এখানে ওখানে ঘুরে বাকিদের শান্ত করার চেষ্টা করছিল। পলাশ আবছা শুনেছিল, কারখানার মালিক নাকি ওদের বস্তির সবাইকে চাকরি থেকে তাড়িয়ে নতুন লোক নিয়ে আবার কারখানা খোলার কথা বলেছে। আর তাতেই কেউ কেউ রেগে গিয়ে রাতের অন্ধকারে লুটপাট করে কারখানা জ্বালিয়ে ওখান থেকে সরে পড়ার প্ল্যান করছে। কাকুর কথা ওরা কোনদিনই শুনত না। সেদিনও কোন ব্যতিক্রম হয় নি। অবশ্য রাত ঘনিয়ে আসার আগেই ঘটে গেছিল আর এক দুর্ঘটনা। রাতে খাওয়ার কথা সেদিন মনে ছিল না কারোর। সন্ধ্যে থেকেই বস্তি খালি হতে শুরু করেছিল একটু একটু করে। পলাশরাও বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে তৈরি। এমন সময় হঠাৎ সাইরেন বাজিয়ে একগাদা পুলিশের গাড়ি এসে ঘিরে ধরেছিল ওদের বস্তিটাকে। সার্চলাইটের প্রবল আলো, গুলি আর পাল্টা গুলির আওয়াজে হঠাৎ দিশাহারা হয়ে ছুট লাগিয়েছিল পলাশ। কাকুকে খুঁজে বের করতেই হবে... আমিনা...! হঠাৎ মাথায় ভারী কি একটা এসে পড়ল, ব্যস আর কিছুই মনে নেই। জ্ঞান ফিরেছিল পুলিশের লকআপে। ততক্ষণে ওর চেনা জগতটা পাল্টে গেছিল অনেকটা। কোদালটা তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি হাত চালালো পলাশ।

***
শহরের আর এক কোণে চোখ ধাঁধানো আলোয় ঢাকা ওভারব্রিজের তলায় রাত্রি ঘনিয়ে এসেছে একটু তাড়াতাড়িই। সারাদিনের কাজ সেরে সামান্য কিছু নাকে-মুখে গুঁজে শ্রান্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়েছিল আমিনা। বুড়ি মা'টা এখনও ফেরেনি ভিক্ষা করে। এত করে মানা করা সত্ত্বেও শোনে না। কে জানে কোন রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে আজ! মরুক গে। রোজ রাতে খেটেখুটে ফিরে আর বুড়িকে খুঁজতে বেরোতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু শান্তিতে ঘুমানোর কি যো আছে? ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসতেই চটের ছাউনির ওপাশ থেকে চিল চিৎকার জুড়েছে বাচ্চা মেয়েটা। বিরক্তিসূচক একটা শব্দ করে পাশ ফিরে শোয় আমিনা। মেয়েটার মায়ের জন্য দুঃখ হয় তার। বার বার বারণ করা সত্ত্বেও আমিনার কথা শোনেনি সে। প্রথম প্রথম একা একা এখানে থাকতে ভয় করত তার। তাই কোথাকার একটা সিটকে লোকের উপর ভরসা করে... একরাতে নিজেই চট সরিয়ে ঢুকতে দিল লোকটাকে। তারপর আর কিছু বলে নি আমিনা। এবারে ভোগো। সে লোক তো ভেগেছে কবেই। দিয়ে গেছে এই দিনরাত জ্বরে ভোগা ছিঁচকাঁদুনে মেয়েটাকে। শহরের বিভিন্ন জায়গায় ফুটপাথের কোণে আর ওভারব্রিজের তলায় নয় নয় করে প্রায় দু'বছর কাটানো হয়ে গেছে আমিনার। সে জানে পুরুষগুলো আসলে কুত্তার জাত। রাত হলেই মদ খেয়ে চট সরিয়ে গায়ের উপর উঠে আসতে চায়। এতগুলো জায়গা বদলানোর পর আমিনা জানে কোথাও এর অন্যথা হয় না। তাই একটা ধারালো চাকু সে সবসময় রেখে দেয় ওর পুঁটলির তলায়। বেশিরভাগ সময় ওটা দেখেই চম্পট দেয় কুত্তাগুলো। তবে একবার চালানোর দরকারও হয়েছিল। রক্ত দেখে নেশা ছুটে গেছিল মাতালটার। শাসাতে শাসাতে বেরিয়ে গেছিল লোকজন জোগাড় করে আনতে। তারা আসার আগেই ওখান থেকে পালিয়েছিল আমিনা। অন্ধকারে পালাতে আর ভয় করে না তার।

সেই নয় বছর বয়স থেকেই তো পালাচ্ছে। থাকতো ওপার বাংলায়। ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে অশান্তির শেষ ছিল না। ওরা যে হিন্দু ছিল! প্রাণে বাঁচতে এক মুসলিমকে বিয়ে করে ওর মা মুসলিম হয়। আর ওর নতুন নাম হয় আমিনা। তার নিজের বেশ ভালোই লেগেছিল নামটা। কিন্তু তারপর এক রাতে কি যে হলো, ওর নতুন বাবা ছুটতে ছুটতে এসে বললো, গ্রামে নাকি দাঙ্গা লেগেছে। পিছনের দরজা দিয়ে পালানোর আগেই একগাদা লোক হুড়মুড় করে ঢুকে পরে ওদের বাড়িতে। আমিনাকে নিয়ে ওর মা পালাতে পারলেও বাবা পারেনি। তারপর আরও অনেক লোকের সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে এদেশে চলে এসেছিল ওরা... চেনা লোকজন, ঘরদোর সব ছেড়ে এসে আস্তানা গেড়েছিল একটা নোংরা বস্তিতে এই শহরেই। তবু সেখানে একটা ঘর ছিল আর মা একটা কাজও পেয়েছিল পাশের বড় কারখানাটায়। বস্তির বাকি ছেলেমেয়েদের সাথে হইহই করে তারও সারাদিন ভালোই কেটে যেত।

তাছাড়া পলাশ ছিল...
প্রথমবার ওর নাম জেনে পলাশ বলেছিল, 'ও, তোরা মুসলমান?'
ওরা কি মুসলমান, না হিন্দু? আমিনা ভালো করে জানত না কোনদিন। এখনও কি ছাই জানে? মা'কে জিজ্ঞাসা করেছিল। মা বলেছিল, 'আমাদের কি আর জাত থাকতে আছে রে?' এ কথার মানেই বা কি তাও আমিনা বোঝে নি তখন। পরে ভেবেছে নিজেই আর একটু বড় হয়ে। ওর নিজের বাপকে তো আর ওর মনেও পড়ে না। ওই লোকটা জন্ম দিয়েছিল বলেই কি সে হিন্দু? আর দ্বিতীয় বাপটা? সেদিন রাতে ওই গুন্ডাগুলোর পায়ের আওয়াজ পেয়ে জোর করে যদি ওদেরকে আগে পিছনের দরজা দিয়ে বের করে না দিত, তাহলে? সে লোকটা জন্ম দেয় নি বলেই কি...। আর তাছাড়া মালতির থেকে আমিনা নামটা তার অনেক বেশি পছন্দ। পলাশও সেদিন বলেছিল, 'যাক্‌গে। তোর নামটা ভালো।' শুনে একগাল হেসেছিল আমিনা। সেই তাদের ভাব। তার পরের পাঁচ-ছয়টা বছর ওদের দু'জনকে আলাদা করে বোধহয় কেউ দেখে নি।

পুলিশ এল যেদিন, সেদিনও তো পলাশ বলেছিল, ওর কাকু ওকে যেখানেই নিয়ে যাক, আমিনা আর ওর মা'ও যেন সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে। কিন্তু কি যে হলো, গোলমালের পর আর পলাশকে খুঁজেই পেল না। পুলিশ অবশ্য পুরুষদের কাউকেই সেদিন ছাড়ে নি। যারা গুলিতে মরে নি, তাদের সবাইকেই নিয়ে গিয়ে জেলে ভরেছিল। আসলে দু'টো পুলিশও সেদিন বেশ জখম হয়েছিল কিনা! কিন্তু পলাশের বয়স তো তখন সবে ষোল। আর ও কারখানায় কাজও করত না... তাহলে! রাতের অন্ধকারেই ডেডবডিগুলো গাড়িতে তুলে পাচার করার জন্য এক জায়গায় জড়ো করছিল পুলিশ। মা'কে লুকিয়ে দেখে এসেছিল আমিনা, আরও অনেকের মাঝে অনিলকাকুর বডিও ছিল, কিন্তু পলাশ ছিল না। যাই হোক্‌, সেই রাতেই ওখান থেকে পালিয়ে আসে তারা বাকি কয়েকটি পরিবার। তারপর থেকেই কখনও এই ফুটপাথ তো কখনও ওই ফুটপাথ। চটের পর্দাটা একটু নড়ে উঠল। মা'টা ফিরে এসেছে। এই চল্লিশ বছর বয়সেই ওর মা'কে দেখলে কেমন ষাট- পঁয়ষট্টির বুড়ি মনে হয়। হঠাৎ মায়ের জন্য খুব দুঃখ হয় তার। পাশে এসে শুতেই আঁকড়ে ধরে মায়ের কোলে মুখ গুঁজে দেয় আমিনা।

***
কোদাল চালাতে চালাতে ডান হাতটা টনটন করে ওঠে পলাশের। সেই যে গোলমালের রাতে ওদের কয়েকজনকে তুলে নিয়ে গেছিল ... তারপর লকআপে রেখে সে কি মার, কি মার! ওদের নামে কোন কেস-টেস দেয়নি পুলিশ। শুধু টানা দু'দিন লকআপে রেখে বেধড়ক লাঠি চালিয়েছিল। মার আটকাতে গিয়ে সেই যে ডানহাতে চোট পেয়েছিল, এই দু'বছরেও সেটা সারে নি পুরোপুরি। টানা বেশিক্ষণ কাজ করলে এখনও সেই পুরনো ব্যথাটা চাগাড় দেয়। কিন্তু থামার তো উপায় নেই। এদের কাজ শেষ করার প্রচুর তাড়া... ২৪ ঘণ্টা কাজ চলছে এখন। ঝাড়া একদিন অপেক্ষা করার পর রাতের শিফ্‌টে কাজ পেয়েছে সে। শুনেছে ঐ পুরনো কারখানার মালিকই নাকি কিনে নিয়েছে জায়গাটা। এই মাঠ নিয়ে আর পুরনো কারখানা ভেঙ্গে ফেলে পুরো জায়গাটা জুড়েই তৈরি হবে বিশাল মাল্টিপ্লেক্স। শেষ অব্দি এই বস্তিতে যারা ছিল, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী কি এক কার্ড দেখাতে পারলে এই জায়গার বিকল্প হিসাবে অন্যত্র বাসস্থান পাওয়ার কথা তাদের সবার। শুনে প্রথমে বেশ খানিকটা আক্ষেপ হয়েছিল পলাশের। কারণ লকআপ থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সে আর এদিকে আসে নি। সেখানেই একজন ওকে অনিলকাকুর মারা যাওয়ার খবরটা দিয়েছিল। তবে এলেই কি আর ঐ কার্ড সে জোগাড় করতে পারত? তার জন্যেও কিসব কাগজপত্র দেখাতে হয় আর নয়তো ঘুষ। গত দু'বছর ধরে নিজের পেট চালাতেই হিমশিম খেয়েছে পলাশ... তার উপরে ঘুষের টাকা!

সেই রাত্রের গোলমালের পর অনেকদিন ফাঁকাই পড়েছিল বস্তিটা। পরে কোথা থেকে যেন একদল উদ্বাস্তু এসে জুটেছিল এখানে। তারা আজ সকালেও এসে কান্নাকাটি করছিল। মাঠের এক কোণে বসে তারই মতো কাজের খোঁজে আসা আরও কয়েকজনের সাথে বসে বিড়ি খেতে খেতে দেখছিল পলাশ। পুলিশ এসে ঝেঁটিয়ে বিদায় করল সবগুলোকে, 'ভাগ শালা, শুয়োরের বাচ্চা...'। হ্যাঁ, শুয়োরের বাচ্চাই তো সব, ওরা সবাই। ওদের থাকার জায়গার ঠিক নেই, পড়ার কাপড়ের ঠিক নেই, খাবার-দাবারের ঠিক নেই... ঠিক শুয়োরের পালের মত। এখন এক জায়গায়। ওখান থেকে ভাগিয়ে দিলে আর এক জায়গায়। বড়লোকদের এঁটো খেয়ে বাঁচে ওরা। সে জিনিস খেতে তো সব জায়গায় একইরকম। তাও লোকে কাঁদে কেন কে জানে! সেও কেঁদেছিল অবশ্য। পুলিশের মার খেয়ে নয়। অনিলকাকুর দুঃখে। লোকটার সাথে রক্তের সম্পর্ক ছিল না তার। কবে কোন এক নর্দমার ধারে ওকে কুড়িয়ে পেয়েছিল কাকু। নিজের সংসার ছিল না। ওকেই নিজের ছেলের মত বুকে করে বড় করেছে। সেই লোকটাও চলে যাওয়াতে দুঃখ পেয়েছিল বইকি। আর আমিনাও। মা-মেয়েতে গেলটাই বা কোথায়? এই দু'বছরে শহরের যেখানেই কাজ নিয়ে গেছে, সেখানেই চারিদিকের বস্তি, ফুটপাথ তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। যতটা সম্ভব বর্ণনা দিয়ে অন্যান্য বস্তির লোকজনকে জিজ্ঞাসা করেছে। কেউ কোন খোঁজ দিতে পারে নি। আকাশ যে কখন কালো করে এসেছে হ্যালোজেনের আলোয় কেউ বুঝতেই পারে নি। হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি নামায় সবাই কাজ থামিয়ে ছাউনির খোঁজে ছুটেছে। যাক্‌, ফাঁকেতালে একটু বিশ্রাম পাওয়া যাবে। কোদাল আর ঝুড়িটা তুলে নিয়ে পলাশও হাঁটা দিল ছাউনির দিকে। 

**
মায়ের ডাক আর ধাক্কার চোটে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমিনার। বাইরে প্রবল বৃষ্টি। রাস্তা থেকে জল গড়িয়ে চলে এসেছে ব্রিজের তলায়। হাঁটুর নিচ থেকে পুরো পা'টাই ভিজে গেছে কখন বুঝতেও পারে নি। কোনরকমে পুঁটলিটা আর চটটা গুটিয়ে ব্রিজের আর একটু ভিতরের দিকে এগোয় ওরা। এর মধ্যেই সেখানে ভিড় জমে গেছে। এত লোকও এসে জোটে বাবা কোথা থেকে... বিহার, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, বাংলাদেশ... কিছুই বাদ নেই। নোংরা আর দুর্গন্ধে টেকা দায়। এদিকে ছিঁচকাঁদুনে মেয়েটা ঘুম ভেঙ্গে উঠে আবার চিল-চিৎকার জুড়েছে। নাঃ, আজ বোধহয় কপালে ঘুম নেই। আর পারা যায় না। এর আগে টালিগঞ্জের ফুটপাথে যেখানে ছিল, ওদের পাশেই শিমুল বলে যে মেয়েটা থাকত তার সাথে খুব ভাব হয়ে গেছিল আমিনার। প্রায় মাস চারেক একসাথে থাকার পর একদিন হঠাৎ বললো কোথায় যেন একটা কাজ পেয়েছে সে। লাফাচ্ছিল আর বলছিল, 'আর ভাত-কাপড় নিয়ে ভাবতে হবে না রে আমিনা। তুইও চল। কিছুদিন পর এসে তোর মা'কে আর আমার বাপকে নিয়ে যাব...' মা'কে ছেড়ে যেতে রাজি হয় নি আমিনা। একদিন একটা লোক আর এক মহিলা এসে নিয়ে গেল শিমুলকে। ওর অথর্ব বাপটা তারপর থেকে কোনদিন খেতে না পেলেই মেয়ের নামে যথেচ্ছ গালিগালাজ করত। ভাবতো বোধহয় মেয়ে আর ফিরবে না। শিমুল ফিরেছিল বাপকে নিতে। একটা পরিষ্কার, রং না চটা আর একটুও না ছেঁড়া আস্ত একটা শাড়ি পড়ে। আমিনার একটাও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সামান্য কিছু জিনিসপত্র আর বাপকে নিয়ে একটা রিক্সায় উঠে বেরিয়ে গেছিল। আর কখনও ওকে দেখে নি আমিনা। এখন মাঝে মাঝে ভাবে আমিনা, চলে গেলেই হত শিমুলের সঙ্গে। ওর মতো সেও মা'কে নিয়ে যেত কিছুদিন পর এসে। কিন্তু শেষদিন কেমন যেন মরা দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়েছিল শিমুল। মাঝে মাঝে রাতে মনে পড়লে গা ছমছম করে ওঠে। তাও কখনও সখনও স্বপ্ন দেখতে ভালোই লাগে, ওইরকম সুন্দর একটা শাড়ি পড়ে কোন একদিন পলাশের পাশে... মায়ের কোলে ঠেস দিয়ে বসে ভাবতে ভাবতেই আবার ঘুমে মাথা নুয়ে এল আমিনার। 

*
বৃষ্টি থামল তখন ভোরের আলো ফুটেছে। বৃষ্টি ধোয়া শহরের সাথেই ঝকঝকে নীল আকাশটাও যেন সেজে উঠেছে পুজোর সাজে। ছাউনি থেকে বেরিয়ে মেন রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বুকভরে নিঃশ্বাস নেয় পলাশ। ওদের শিফ্‌ট শেষ। নতুন শিফ্‌টের লোকজন আসতে শুরু করেছে একে একে। রাতের কাজের হিসাব বুঝিয়ে নিজের মজুরির ভাগটুকু নিয়ে উল্টোদিকে হাঁটা লাগায় সে। ছাউনিতে বসে বসেই ঘণ্টা দু’য়েক ঘুমিয়ে নিয়েছে। সল্টলেকে মেট্রোরেলের কাজ চলছে পুরোদমে। আগের দিনই খবর পেয়েছে ওখানে কিছু দিনমজুরের প্রয়োজন।

আমিনাও তৈরি কাজে বেরনোর জন্য। খবর পেয়েছে ওদের পুরনো বস্তির মাঠটায় নাকি বড়লোকদের কিসব বাজার-ফাজার হবে। ওখানে কন্সট্রাকশনের কাজে বেশ কিছু মহিলা শ্রমিক দরকার। পৌনে দু'মাইলের হাঁটা পথ। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়াই ভালো।


*******
লেখকের সম্পর্কে জানতে এই পাতায় আসুন

9 comments:

  1. শুভ, কি ফ্যান্টাস্টিক লিখেছিস রে। গপ্পোটার সব চেয়ে ভাল ব্যাপারটা হল, পলাশ আর আমিনার দেখা না হওয়াটা। তাহলেই এটা সব পেয়েছির গল্প ইত্যাদি হয়ে যেত। কথা-স্পেশালকে স্পেশাল অভিনন্দন রইলো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে জয়দা, থ্যাঙ্কু, থ্যাঙ্কু।

      Delete
  2. আগে আলাদা করে বলেছি, এবার সর্বসমক্ষে বললাম:

    লাল সেলাম, কমরেড! :P

    প্রলেতারিয়েত প্রেমের গল্প... মিলনে শেষ হয়নি, বিরহেও নয়, শেষ হয়েছে pro-life মুডে। সেটা আবার pro-letariat দের বেঁচে থাকার একমাত্র কায়দা! জাত-বেজাতের বজ্জাতি, eviction, Foucault-ish পুলিশি বর্বরতা- সব মিলিয়ে যা হয়েছে, কমরেড উৎপল দত্ত বেঁচে থাকলে লুফে নিত। সেলাম নেবেন...

    তবে, মনে রাখতে হবে, সরকার কিন্তু কমরেডদের এখনো বেশি-রেড বলেই দেখে ;) ;)

    ReplyDelete
  3. ভাই, দুর্দান্ত লেখা। পুরো লেখাটা একটা 'কি হয়, কি হয়' ভাব নিয়ে পড়ে ফেললাম। আর তার সাথে দুর্দান্ত ছবি। দ্বিতীয় ছবিটা কি আঁকা?

    ReplyDelete
    Replies
    1. দু'টো ছবিই আমার তোলা, তারপর নির্লজ্জের মতো এডিট করা... ২য় ছবিটা আমাদের কাজের দিদির- কল্পনাদি... :)

      Delete
    2. আবির, প্রশংসাটুকু পকেটে পুরে নিলুম, আর প্রশ্নের উত্তর তো পেয়েই গেছিস :)

      Delete
    3. সুনন্দ, নির্লজ্জের মত সুন্দর হয়েছে এডিটটা। তোলা ছবি নিয়ে এরকম কারুকার্য, আকাঁর থেকে কোন অংশে কম নয়। আর তার সাথে ঠিক ঠিক যায়গা মত ফিট করে দেওয়া, এটাও বাহবার দাবি রাখে ভাই।
      শুভ, এরকম লিখে গেলে প্রশংসা আর পকেটে কুলোবে না। বস্তা-টস্তা লাগবে। :)

      Delete
  4. বেশ ভালো হয়েছে পাপনদা। অবশ্য এই নাম-এ এখানে probably কেও চেনে না . . . .
    এরকম আর কিছু লেখা-র আশায় থাকলাম।

    ReplyDelete